Saturday, December 20, 2014

ছয় দফা : শহীদের রক্তে লেখা "তোফায়েল আহমেদ" প্রকাশ : ০৭ জুন, ২০১৪






আজ ঐতিহাসিক ৭ই জুন। ১৯৬৬ সালের এই দিনে পাকিস্তানের তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের গণতন্ত্রকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন। বাংলার গণমানুষ স্বাধিকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জুন সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। বাংলা মায়ের দামাল সন্তানরা এদিন তাদের জীবন উৎসর্গ করে গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বাংলার মানুষের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করেছে। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর 'ছয় দফা দিবস' হিসেবে পালিত হয়
স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে চিরস্থায়ীভাবে শৃঙ্খলিত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তার বিরুদ্ধে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব '৬৬- ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিসংবলিত বাঙালির 'ম্যাগনাকার্টা'খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে ছয় দফা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ছয় দফা প্রচার প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয় এবং তাঁরই নামে পুস্তিকাটি মুদ্রিত হয়। একই বছরের ১৮, ১৯ ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। ছয় দফা কর্মসূচি দলীয় কর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে ছয় দফা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরেই এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।' বস্তুত ছয় দফা ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর

ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে '৬৬- মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিনের সেই কাউন্সিল সভায় আগত এক হাজার ৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ছয় দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করে। ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা পরবর্তীকালে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন, যা '৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থান, '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন '৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, 'ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়- প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।' স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে' উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, 'এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।' বঙ্গবন্ধু জানতেন ছয় দফাই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি অতিক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। কী ছিল ছয় দফায়-

নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেল রাষ্ট্র; সংসদীয় পদ্ধতির সরকার; সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং এর ভিত্তিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচন। নম্বর দফায় ফেডারেল সরকারে দুটি বিষয় ন্যস্ত থাকবে, প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র; অন্য সব বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে। নম্বর দফায় দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন, অথবা একক মুদ্রা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে। নম্বর দফায় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে করারোপ রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। ফেডারেল কেন্দ্রের হাতে রকম কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় বা চাহিদা মেটানোর জন্য প্রদেশগুলোর করের একটা অংশ পাবে। নম্বর দফায় দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব রাখা; দেশের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে; ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন দুই অঞ্চল কর্তৃক সমান হারে অথবা নির্ধারণযোগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চল কর্তৃক মেটানো হবে; দেশজ পণ্য দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে অবাধে চলাচল করবে; সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটের সরকারগুলো বিদেশে বাণিজ্য মিশন খোলা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করবে। সর্বশেষ নম্বর দফায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে। ছয় দফার মূল বিষয়বস্তু ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ছয় দফার পক্ষে জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের কারণ হচ্ছে, দাবিগুলো প্রকৃতপক্ষে শুধু বাংলা নয়, তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরও দীর্ঘকালের দাবি
বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর সফরসঙ্গীসহ উত্তরাঞ্চলে যান '৬৬- এপ্রিল। ওই দিন পাবনায় এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন। অতঃপর তারিখ বগুড়া, তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুর ঝটিকা সফরে ছয় দফার সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর নেমে আসে নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রতিটি জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিটি জেলা থেকে জারীকৃত ওয়ারেন্ট বলে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৭ এপ্রিল ভোর ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারীকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ () ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস থেকে তিনি জামিন পান। এরপর সেদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, আবার জামিনের আবেদন, ২৩ তারিখ জামিনলাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। এভাবেই আইয়ুবের দমননীতি চলতে থাকে। একই বছরের মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ঐতিহাসিক 'মে দিবস' স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে। ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ () '' ধারা বলে তাঁকেসহ তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরপর দেশরক্ষা আইনের আওতায় চলতে থাকে আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন। সামরিক সরকারের এমন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে 'প্রতিবাদ দিবস' পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি মানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। কয়েক সহস্র শ্রমিক এদিনে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। এর পরপরই দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ীভাবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতাদের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। জুনের হরতালে গোটা পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ সেদিন স্বাধিকার বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ভিপি। শেখ ফজলুল হক মণি, আমাদের প্রিয় মণি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা যারা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলাম- সর্বজনাব সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরো অনেকে- আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার স্মৃতিপটে এখনো ভাস্বর হয়ে আছে সেদিনটি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মণি ভাই এসেছেন হরতালের সপক্ষে প্রচারকাজ চালানোর জন্য। তিনি তখন ছাত্র নন। . ওদুদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। তিনি মণি ভাইকে বললেন, 'মণি, তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাসে অবস্থান কোরো না, চলে যাও। তুমি যদি না যাও তবে আমার চাকরি যাবে।' মণি ভাই স্যারের কথায় সবিনয়ে সম্মতি জানিয়ে আমাদের হরতাল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ফলে তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী নূরে আলম সিদ্দিকী। তাঁরা সেখানে বক্তৃতা করেন
প্রকৃতপক্ষে জুন স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। সেদিন আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতেই। ১৯৫২- ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৬২- ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলন; '৬৬- জুন ছয় দফা আন্দোলন; '৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়রি গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান; ফেব্রুয়ারি ১১ দফা বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শপথ দিবস পালন; স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান; ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ; এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রদান। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছিল গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নিয়েছিল বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। অতীতে আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতিবছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধিবিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিধান মোতাবেক '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরে আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এক বছর পরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ মার্চের মধ্যে সম্মেলন করে নূরে আলম সিদ্দিকী শাজাহান সিরাজের কাছে নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করে আমাদের কমিটি বিদায় নেয় এবং ২২ মার্চ হল ত্যাগ করে গ্রীন রোডে একটি বাসা ভাড়া করে আমি এবং শ্রদ্ধাভাজন নেতা রাজ্জাক ভাই বসবাস শুরু করি। আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায়ের, মুজিবাদর্শ প্রতিষ্ঠার অগ্রবর্তী সংগঠন। মূলত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বই সেদিন সারা দেশে জুনের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে স্বাধিকারের পথে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। আর বাংলার মেহনতি মানুষ আত্মত্যাগের অপার মহিমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীসহ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ছয় দফাই হচ্ছে বাঙালির জাতীয় মুক্তির একমাত্র পথ
ছয় দফাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ছয় দফার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাঁকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। '৬৬- মে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েও ছয় দফার আন্দোলনকে যখন রোধ করা যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে চিরতরে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা দেন। ছয় দফা দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ আমরা যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা '৬৯-এর জানুয়ারির তারিখে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয় দফাকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। এর ফলে ১১ দফা আন্দোলনের সপক্ষে সারা দেশে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণি আমাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' হিসেবে চিত্রিত করে। তাদের এই অপপ্রয়াসের সমূচিত জবাব দিতে '৬৯-এর ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে বলেছিলাম, 'পূর্ব বাংলার মানুষ কোনোদিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয়। কারণ তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন। যদি কারো পূর্ব বাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।' নেতার এই নির্দেশ আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মেনে চলেছি। পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালানোর আগ পর্যন্ত কোনো রকম উগ্রতাকে অতি বিপ্লবীপনাকে আমরা প্রশ্রয় দিইনি। নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে আমাদের কখনোই অভিযুক্ত করা যায়নি। আমরা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ন্যায্যতা প্রমাণ করে মুক্তিসংগ্রামী হিসেবেই এগিয়ে গেছি। আর এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে জুনের কর্মসূচি পালনকালে শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান
জুনের হরতাল সম্পর্কে শ্রদ্ধাভাজন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাকে লেখেন, 'যদিও প্রতিক্রিয়াশীলরা অতীতের মতই বিধি-নিষেধ আরোপক ব্যবস্থাদির পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে এবং মাত্র একটিবারের জন্য হলেও ইতিহাসের পুরানো পাতার প্রতি দৃক্পাত মাত্র না করেই ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে তবু এবার জনগণ তাদের পূর্ণ অধিকার আদায়ে সংকল্পবদ্ধ।' ছয় দফার পক্ষে জুনের হরতাল এতটাই সর্বব্যাপী ছিল যে, সম্পর্কে কোনো রকম প্রতিবেদন মুদ্রণ প্রকাশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও মানিক মিয়া তাঁর কলামে লেখেন, 'ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থাদির কারণে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় হলো এই যে, জনসাধারণ ছয় দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে।' ছয় দফার পক্ষে, জুনের সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচির পক্ষে জনমত তৈরিতে ইত্তেফাকের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে '৬৬- ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২() ধারার আওতায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার এবং দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে সামরিক জান্তা। পরবর্তীকালে '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক এবং বাজেয়াপ্তকৃত নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসটি ফেরত প্রদানে স্বৈরশাসক বাধ্য হয়েছিল
মূলত ছয় দফা দাবি আদায় পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তির জন্যই জুন আমরা হরতাল পালন করেছিলাম, সংগ্রাম করেছিলাম। জুনের হরতালে মুজিবুল্লাহ, মনু মিয়াসহ অসংখ্য মেহনতি মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধিকারের দাবি ছয় দফা লিখে গিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেছে। জুনে যে সার্বভৌম পার্লামেন্টের দাবিতে আমরা ছয় দফার পক্ষে সংগ্রাম করেছিলাম সেই কর্মসূচির ফলই হচ্ছে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। জুন ছিল এর সূচনাবিন্দু
আজ ভাবতে কত ভালো লাগে যে, আমাদের জাতীয় জীবনে শত শহীদের রক্তে লেখা এদিনটি চেতনায় জাতীয় মুক্তির যে অগ্নিশিখার জন্ম দিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক এই জুনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এবং তাঁরই নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। আওয়ামী লীগে যোগদানের পর বঙ্গবন্ধু আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আমাকে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। এরপর '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নির্দেশে মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আমাকে তাঁর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ দেন। অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহে আমার জীবন ধন্য। জুনের চেতনাবহ এই দিনটি আমার জীবনে অম্লান হয়ে আছে। যেসব শহীদ ভাইয়ের প্রাণের বিনিময়ে সংগ্রামপরম্পরায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে, তাঁদের পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জুন আমাদের স্বাধিকার স্বাধীনতার চেতনার আরম্ভবিন্দু। এই দিনটিতে জুনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা কর্তব্য বলে মনে করি
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
tofailahmed69@gmail.com


No comments: