Monday, October 3, 2011

এক বাসেই জীবন পার...


সকালবেলা। মিরপুর টু মতিঝিল। অনেকক্ষণ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তুষার যে বাসটাতে উঠল, পরের কাউন্টারেই সেটা মানুষে ঠেসে গেল। এর মধ্যে একটা সুন্দরী মেয়েও উঠল। একেবারে পেছনের দিকের একটা সিটে বসায় প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তুষারের পক্ষে মেয়েটিকে বসতে দিয়ে সম্মানিত বোধ করার সুযোগটুকু হলো না। বাস চলে আর তুষার ভাবে, তুষার ভাবে আর বাস চলে। একটু ঘুরিয়ে বলি। বাস চলার ভান করে, কিন্তু তুষার ঠিকই ভাবে, তুষার ঠিকই ভাবে কিন্তু বাস চলার ভান করে। একটু পরপর ব্রেক করে। তাতে ঠাসাঠাসির ফাঁকে আরও কিছু নতুন যাত্রী টুপটাপ উঠে পড়ে। 
একসময় মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হয় তুষারের। মেয়েটি বোধ হয় একটু হাসেও। তুষার গলে বাস ভিজে যাওয়ার উপক্রম! কিন্তু গলে না। আচমকা কি যেন হলো। টুপটাপ বাস থেকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো নেমে গেল! মেয়েটি এসে তুষারের ঠিক পাশের সিটে গিয়ে বসে। মেয়েটি তুষারকে বলে, তার মন খারাপ। সে যেন এমন কিছু বলে, যাতে তার মন ভালো হয়ে যায়। তুষার তার খুব পরিচিত একটা জোক বলে।
আফ্রিকার এক যোগাযোগমন্ত্রী কোথাও যাচ্ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার ওপর একটা গাধা ছুটে এসে গাড়ির নিচে পড়ে মারা যায়। মন্ত্রী তাঁর ড্রাইভারকে বললেন তাড়াতাড়ি পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে গাধাটা কার খোঁজ নিতে, তিনি তাঁর যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবেন। ড্রাইভার চলে গেল। খানিক পরে সে ফিরেও এল। তার গলায় ফুলের মালা। মন্ত্রী অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কী ব্যাপার। ড্রাইভার বলল, ‘আমি গ্রামে গিয়ে শুধু বললাম, “আমি যোগাযোগমন্ত্রীর গাড়ির ড্রাইভার। একটু আগে গাধাটা মরেছে।” সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাকে কোলে তুলে নাচল, ফুলের মালা পরিয়ে দিল!’
জোকটা শুনে মেয়েটি হেসে কুটিকুটি, গড়িয়ে পড়ে তুষারের গায়ে। তার মন খুব ভালো হয়ে যায়। 
একটু পরেই বাসে গুনগুন করে কে যেন একটা মিষ্টি প্রেমের গান গেয়ে ওঠে। অন্য সব যাত্রী তাকায়। সবার চোখে খুশির ঝিলিক, মুখে আকর্ণ হাসি। তুষারকে নিয়ে মেয়েটি গান গায়। তুষারও সাড়া দেয় গানে। আর সবাই হাততালি দিয়ে তাল ধরে। ড্রাইভার খুশিতে শিস না বাজিয়ে গগনবিদারী হর্ন বাজায়।
সূর্য তেতে ওঠে মাথার ওপর। বাসের ছাদে ফ্যান নেই। ফ্যান থাকলেও অবশ্য কোনো কাজ হতো না। বাসেও আজকাল লোডশেডিং, লোডশেডিং সর্বত্র। প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার, তেমনি আমাদের ইলেকট্রিসিটির আড়ালে লোডশেডিং। 
কত দিন ধরে বাসটা চলছে কে জানে! তুষার আর মেয়েটির মধ্যকার প্রেম ঘনীভূত হয়। ওঠে বিয়ের কথা। বাসের যাত্রীরা দুই ভাগ হয়ে গেল। একদল বরপক্ষ, আরেক দল কনেপক্ষ। অনেক বাগিবতণ্ডার পর একটা কিছুতে উভয় দল রাজি হলো। বাসে একজন কাজিও পাওয়া গেল। আর কোথায় যায়, কাজি দিলেন বিয়ে পড়িয়ে। স্বামী-স্ত্রী মহাখুশি। এই সময় বাসে পাওয়া গেল একজন পপকর্নওয়ালাকে। সে সবাইকে পপকর্ন খাওয়াল। সুখে-শান্তিতে বাস এগোতে লাগল।
আচমকা একটা জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। গরমে একজন বয়স্ক লোক বাসের ভেতর মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। পানি! পানি!! তুষারের মনে পড়ল, গত কয়েক সপ্তাহ তার বাসায়ও ঠিকমতো পানি আসে না। বাসের মধ্যে একজন ডাক্তারও পাওয়া গেল। সে সবাইকে সরে গিয়ে বাতাসের জন্য পথ করে দিল। ফ্যানও নেই, পানিও নেই। একটু পরেই বৃদ্ধ লোকটি মারা গেলেন। বাসের সবার মন খারাপ। আহারে, বেচারা! মৃত্যুর সময় সামান্য পানিও মুখে দিতে পারল না।
তখনো বাসজুড়ে শোকের ছায়া। এরই মধ্যে সদ্যোজাত এক শিশুর কান্নার শব্দে সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। একটু আগের শোকের কথা বেমালুম ভুলে গেল সবাই। নবাগত শিশুটিকে নিয়ে সবাই মেতে উঠল অন্য রকম এক আনন্দে। তুষারের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ছুটে গিয়ে শিশুটিকে কোলে নিল। 
তারা সবাই আবার একটা খুশির গান গাইল। ড্রাইভার আবার গগনবিদারী হর্ন বাজাল। হর্নের শব্দে নবাগত শিশুটি ভ্যা-ভ্যা করে কেঁদে উঠল। এটা নিয়েও হাসল সবাই। হেসে গড়াগড়ি খেল একজন আরেকজনের গায়ে।
একটা ছোট্ট ছেলে পানি নিয়ে উঠল বাসে। সবাইকে পানি খাইয়ে নেমে গেল। সবাই ঘুমে ঢুলুঢুলু। চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে গেল দোকানের শাটারের মতো।
হঠাৎ কড়া একটা ব্রেক করে থেমে গেল বাস। ড্রাইভার জানাল, বাসের গ্যাস শেষ। গ্যাস না আসা পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে।
হঠাৎ একটা কড়া ব্রেকে তুষারের তন্দ্রা ভাবটা কেটে গেল। বাস মানুষে ঠাসা। চোখ কচলে তুষার সামনে তাকাল। মেয়েটি একটা সিটে বসে আছে, এত মানুষের ফাঁকে ভালো করে দেখা যায় না। দ্রুত বাইরের দিকে তাকাল। মতিঝিলে তার অফিস। সকাল নয়টায় ইন। বাসা থেকে সাড়ে সাতটায় বের হয়েছে। বাস এখন ফার্মগেট পার হয়ে কেবল কারওয়ান বাজারের জ্যামে। একটা বিশাল লম্বা জ্যামের মাঝামাঝি তাদের বাস। তবু তুষার খুশি। ঠিক যেখানে স্বপ্নটা শেষ হয়েছে ওখান থেকে বাকিটা দেখে ফেলতে পারবে মতিঝিল যেতে যেতে। স্বপ্ন তো খারাপ বিষয় না। এভাবে স্বপ্ন দেখে দেখে পাঁচ-দশ বছর অনায়াসে পার করে দেওয়া সম্ভব! 
তুষার মনে মনে ভাবে, আমাদের দেশে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় মজাটা হচ্ছে—আমাদের এই সমস্যাগুলো আমাদের কল্পনার চেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী। ফলে আমরা এগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখনো বোর ফিল করি না। না জনগণ, না জনপ্রতিনিধি! আসলে আমরা সুখী জাতিই বটে! শত সমস্যার মধ্যেও আমরা কত সুন্দর স্বপ্ন আর দিবাস্বপ্ন দেখে সমস্যাগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দিব্যি হাসি-আনন্দে বেঁচে থাকি!

All About Entertainment

1 comment:

Unknown said...

Really enjoyed that! nice setting. A friend of mine was telling me an idea almost like yours, but yours was a lot of fun!