Saturday, December 20, 2014

সেকাল ও একালের রাজনীতি, তোফয়েল আহমেদ প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর, ২০১৩ ১৬:৫৪:৩৬

তোফয়েল আহমেদ
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর, ২০১৩ ১৬:৫৪:৩৬

অনেকেই প্রশ্ন করেন, সেদিনের অর্থাৎ আমাদের যুগের রাজনীতি কেমন ছিল? আসলে সেদিনের রাজনীতিই ছিল সত্যিকারের রাজনীতি। আমদের ছাত্রাবস্থায় তখন যারা রাজনীতি করতেন, তাদের ব্যক্তিগত লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়া কিছু ছিল না। রাজনীতির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-আদর্শ ছিল। কতো কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করে আমরা ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠা করেছি। ডাকসুর ভিপি ছিলাম, ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। অথচ এমন দিন গেছে অফিস ভাড়া দিতে পারিনি। আমাদের সামনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল, জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্য ছিল। আমাদের জীবনে কোনো বিলাসিতা ছিলো না। শৈশব থেকে বিকশিত জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলোই তার সাক্ষ্য বহন করে।

ছেলেবেলা থেকেই আমি লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী ছিলাম। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা শুরু করি। তখন প্রত্যেকটি ক্লাশে প্রথম হতাম। বর্ষাকালে কর্দমাক্ত পথে খালি পায়ে স্কুলে যেতাম। কিন্তু স্কুলে যাওয়া আসা কষ্টকর ছিল। এ বয়সের একটি ছেলেকে ৭ মাইল পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। বাধ্য হয়ে প্রথমে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে এবং পরবর্তীতে তিনটি বাড়িতে লজিং থাকতে হয়েছে। অপরের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করতে হয়েছে। তারা আমাকে খুবই ভালবাসতেন। যখন আমার বয়স ১৩, তখন বাড়ির পাশে খায়েরহাট হাই স্কুলে ভর্তি হই। নিয়মিত বির্তক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম।

ছয় দফা : শহীদের রক্তে লেখা "তোফায়েল আহমেদ" প্রকাশ : ০৭ জুন, ২০১৪






আজ ঐতিহাসিক ৭ই জুন। ১৯৬৬ সালের এই দিনে পাকিস্তানের তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের গণতন্ত্রকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন। বাংলার গণমানুষ স্বাধিকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জুন সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। বাংলা মায়ের দামাল সন্তানরা এদিন তাদের জীবন উৎসর্গ করে গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বাংলার মানুষের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করেছে। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর 'ছয় দফা দিবস' হিসেবে পালিত হয়
স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে চিরস্থায়ীভাবে শৃঙ্খলিত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তার বিরুদ্ধে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব '৬৬- ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিসংবলিত বাঙালির 'ম্যাগনাকার্টা'খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে ছয় দফা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ছয় দফা প্রচার প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয় এবং তাঁরই নামে পুস্তিকাটি মুদ্রিত হয়। একই বছরের ১৮, ১৯ ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। ছয় দফা কর্মসূচি দলীয় কর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে ছয় দফা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরেই এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।' বস্তুত ছয় দফা ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর

ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে '৬৬- মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিনের সেই কাউন্সিল সভায় আগত এক হাজার ৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ছয় দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করে। ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা পরবর্তীকালে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন, যা '৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থান, '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন '৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, 'ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়- প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।' স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে' উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, 'এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।' বঙ্গবন্ধু জানতেন ছয় দফাই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি অতিক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। কী ছিল ছয় দফায়-

Thursday, December 18, 2014

নিরস্ত্র বাঙালীর সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর "তোফায়েল আহমেদ"


১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ৭ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ইতিহাসের মহামানব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে জাতির উদ্দেশে প্রদান করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্য। ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ কোটি কণ্ঠের সঙ্গে একাকার হয়ে যে মহিমান্বিত ঐকনিনাদ বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়, তাতে জাতিগত বঞ্চনার শিকার বাঙালীর স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যক্ত হয়েছিল।
স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর। বিজয়ী দল সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য অধিবেশনে মিলিত হবে এই ছিল জাতীয় অভিলাষ। কিন্তু জনমনে কাক্সিক্ষত এ রকম একটি গণঅভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ। দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে চারদিকে। বিশেষ করে ঢাকার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শতসহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হয় পল্টন ময়দান। বিকেল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিবাদ সভায় জনসাধারণকে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। আজকাল অনেকেই ইতিহাসের অমোঘ সত্যকে এড়িয়ে নিজেকে বড় করে দেখাতে গিয়ে ইতিহাসকে বিকৃতি করে মননের দীনতা ও নীচতা প্রকাশ করে বিভিন্ন মিডিয়ায়। অথচ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রক্তঝরা প্রতিটি দিনের কর্মসূচী নির্ধারণ হতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়।
২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।