মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ
প্রাপ্তির ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে এ বছর। এই উপলক্ষে মনে পড়ছে ১৯৭৪-এর ২৫
সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ৪০ বছর আগের
সেদিনটি ছিল বুধবার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরসঙ্গী
হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে যোগদানের দুর্লভ সৌভাগ্য
আমার হয়েছিল। বছর ঘুরে দিনটি এলে অনুপম সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মানসপটে
ভেসে ওঠে। আমাদের জাতীয় জীবনে এদিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতির জনকের
দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের
অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করেছেন। প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি
আমাদের এই প্রগাঢ় ভালোবাসার ফলেই ১৯৫২-এ সংঘটিত মহান ভাষা আন্দোলনের
স্মৃতি-বিজড়িত শহীদ দিবস ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপিত হয়। এর শুভ উদ্বোধনটি হয়েছিল
মূলত মানব জাতির সর্বোচ্চ ফোরাম জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মাতৃভাষা বাংলায়
ভাষণের মধ্যদিয়ে।
ঐতিহাসিক এই দিনটির সূচনা হয়েছিল একই
বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ
পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য
রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে
অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি
যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার
সঙ্গে স্মরণ করবে যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা
করতে তাদের জীবন উত্সর্গ করে গেছেন। সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার
সঙ্গে স্মরণ করছে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের এই অর্জন মূলত বঙ্গবন্ধুর
রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে
বিরাট সাফল্যেরই প্রতিশ্রুতি। এই শুভসন্ধিক্ষণকে সামনে রেখেই জাতিসংঘের
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর সফরসূচি ঠিক করা হয়। সেই
হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার সকাল সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন
ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি। সর্বমোট ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন—
পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ডঃ নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর
ব্যক্তিগত চিকিত্সক ডাঃ নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও ওয়েল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের
চেয়ারম্যান ডঃ হাবিবুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান
এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আরো অনেকে। লন্ডনে
যাত্রাবিরতির পর ঐদিন রাতে প্যান অ্যামের নিউইয়র্ক ফ্লাইটে স্থানীয় সময় রাত
সাড়ে আটটায় আমরা কেনেডি বিমান বন্দরে অবতরণ করি। বিমান বন্দরে সংবর্ধনা
জানাতে উপস্থিত ছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রে
নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এস
এ করিম। বিমান বন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু এবং কামাল হোসেনকে হোটেল ‘ওয়ালডর্ফ
অ্যাস্টোরিয়া’য় আর আমাদের অন্য এক হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হোটেল
কক্ষে প্রবেশ করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোফায়েল কোথায়?’ কর্মকর্তাগণ জানান,
‘স্যার এটা তো খুব এক্সপেনসিভ হোটেল, তাই তাদেরকে অন্যত্র রাখা হয়েছে।’ তখন
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কেন, তোমরা জানো না তোফায়েল তো মন্ত্রীর পদমর্যাদায়? যাও
তাকে নিয়ে এসো এবং আমার কাছাকাছি তোফায়েলকে জায়গা দাও।’ বঙ্গবন্ধুর
নির্দেশমত দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ দ্রুতগতিতে আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি
থাকার ব্যবস্থা করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু অপার পিতৃস্নেহে আমাকে দেখেছেন। সব
সময় নিজের কাছাকাছি চোখে চোখে রেখেছেন।
‘ওয়ালডর্ফ
অ্যাস্টোরিয়া’য় বঙ্গবন্ধুর হোটেল কক্ষে দর্শনার্থীদের আগমন ছিল চোখে পড়ার
মতো। অধিবেশনে আগত প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ লোকজনও বঙ্গবন্ধুর
দর্শনপ্রার্থী ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী
কিসিঞ্জার হোটেল কক্ষে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এরপর আসে
প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সদ্য
সদস্যপদপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা।
নিউইয়র্ক সময় বিকাল ৩টায় এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় যখন বক্তৃতা প্রদানের
জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুহুর্মুহু করতালিতে
চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে
পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতৃবৃন্দকে সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ
সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু
তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি
মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও
ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক
নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।’ তিনি আরো
বলেন, ‘জাতিসংঘের সনদে যে সব মহান আদর্শ উত্কীর্ণ রয়েছে তারই জন্যে আমাদের
দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ত্যাগস্বীকার করেছে।’ সেদিন সাধারণ পরিষদের
অধিবেশনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন, আলজেরিয়ার তত্কালীন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বর্তমানে দেশটির রাষ্ট্রপতি—আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা।
তাঁকে আমি ইতিপূর্বেই কাছ থেকে দেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে
নেয়ার জন্য ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদিনের
বিশেষ বিমান নিয়ে যে পাঁচজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের
অন্যতম। বক্তা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার
সাথে সাথে পরিষদের সভাপতি স্বীয় আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে
নিয়েছিলেন। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে
সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন
দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ বিপুলভাবে করতালি দিয়ে
আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য। নিজ চোখে না
দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভবপর নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ছিল
গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি।
আমার মনে পড়ে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যগণ আমাদের
কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম
দিয়েছো, যিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা নন— এশিয়ার নেতা নন; তিনি সমগ্র
বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’
বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি
ইংরেজীতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও
মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে
চাই।’ সিদ্ধান্তটি তিনি আগেই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজী
ভাষান্তর করার গুরু দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল জনাব ফারুক চৌধুরীর উপর। তিনি
ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। ছুটিতে দেশে এসেছেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘ফারুক, তোমার ছুটি নাই। তোমাকে এখানে কাজ করতে হবে।’
কাজগুলি হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর আসন্ন
বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ; বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বার্মার
(বর্তমান মিয়ানমার) সাথে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে প্রতিনিধি দল নিয়ে
বার্মায় গমন। বার্মা থেকে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে
বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডন যাওয়া চলবে না। তুমি আমার সাথে নিউইয়র্ক যাবে এবং
জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করবো, তাত্ক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার
ইংরেজী ভাষান্তর করবে।’ ফারুক ভাই সুন্দর ইংরেজী বলেন ও লিখেন। প্রথমে
ফারুক ভাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু
বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে যেন তুমিই
প্রধানমন্ত্রী। তবে, পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’
এরপর ২৯
সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিজনিত
সমস্যা এবং বাংলাদেশে সর্বনাশা বন্যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায়
জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল
অংশগ্রহণের। কাছ থেকে দেখেছি অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় জাতিসংঘ
মহাসচিবের কাছে স্বদেশের প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার পর জাতিসংঘ বাংলাদেশের ত্রাণকার্যে ৭০ লাখ ডলার
সহায়তা প্রদান করেছিল এবং উপ-মহাসচিব ডঃ ভিক্টর উমব্রাইখটকে বাংলাদেশের
সমস্যার প্রতি বিশেষ নজর রাখার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। তারপর মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে
অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে অক্টোবরের ১ তারিখ সকাল ১০টায় আমরা নিউইয়র্ক থেকে
ওয়শিংটনের এন্ড্রুজ বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করি। ওয়াশিংটনে আমাদের থাকার
ব্যবস্থা করা হয়েছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতির অতিথিশালা ব্লেয়ার হাউজে। সকাল
১১টায় ব্লেয়ার হাউসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম স্যাক্সবি। বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু
প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সাথে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী
উভয়পক্ষের সফল বৈঠকের পর বিকাল সাড়ে ৪টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন
সাংবাদিক সাক্ষাত্কারে মিলিত হন। বিকাল ৫টায় সাক্ষাত্ করেন বিশ্বব্যাংকের
প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে নিউইয়র্ক সিটি হলে
আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় নিউইয়র্কের মেয়র বঙ্গবন্ধুকে নগরীর চাবি উপহার দেন
এবং বলেন, ‘এই উপহার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের প্রতি আমেরিকার
জনগণের শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন।’ প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন সেইসব শহীদের আর সাড়ে
সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে এই চাবি গ্রহণ করে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন।’
বক্তৃতায় তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমেরিকার জনগণ
যেভাবে সমর্থন যুগিয়েছিলো আমি চিরকাল তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো।’
নিউইর্য়ক নগরীর মেয়রের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘নিউইর্য়ক নগরীতে জাতিসংঘের সদর
দপ্তর অবস্থিত বিধায় এই নগরীর বিশ্বের সকল দেশের প্রতি এক বিশেষ দায়িত্ব
আছে।’ পরদিন অক্টোবরের ২ তারিখ সকালে সিনেটর কেনেডী ও জর্জ ম্যাকভার্ন
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পৃথক পৃথক সাক্ষাত্কারে মিলিত হন। বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধুর
সম্মানে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির পক্ষে নাগরিক
সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে
যোগদান উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই সফর ছিল অসংখ্য কর্মসূচিতে ঠাসা।
সদ্য-স্বাধীন একটি দেশের জাতির জনকের আগমনকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক নগরীর
বিদ্ব্যত্ সমাজে বিশেষ ঔত্সুক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। মনে পড়ে, হোটেল ‘ওয়ালডর্ফ
অ্যাস্টোরিয়া’র রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি। আমার সামনেই উপবিষ্ট একটি
পরিবার। পরিচয়ের শুরুতেই তারা আমায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে
এসেছো?’ আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তখন তাদের মুখে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি কথাই উচ্চারিত হয়, ‘ও, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব! তিনি
একজন মহান নেতা।’ পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি তাঁর পলিটিক্যাল সেক্রেটারী।
কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমার মতো অল্পবয়সী একজন কী করে
বিশ্বখ্যাত নেতা শেখ মুজিবের পলিটিক্যাল সেক্রেটারী হতে পারে! কেবল বললেন,
‘আর ইউ শিওর?’ আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। তখন তারা বলেছিলেন, ‘আমরা
মুজিবকে শ্রদ্ধা করি।’ তারপরে যখন বঙ্গবন্ধুকে আমি ঘটনাটি ব্যক্ত করি তিনি
বললেন, ‘তাদেরকে নিয়ে এসো।’ তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে এলাম। অপার
বিস্ময়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপে
মগ্ন হলেন। শুধুমাত্র বাঙালিদের কাছে নয়, বিদেশিদের কাছেও বঙ্গবন্ধু পরম
শ্রদ্ধার আসনে আসীন।
অথচ দুঃখ হয়, যখন দেখি স্বদেশের কিছু
অরাজনৈতিক ব্যক্তি কিছু বই লিখে অসত্য তথ্য পরিবেশন করে মহান জাতীয়
মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চায়, বঙ্গবন্ধু
সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ায়। যে নেতাকে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কগণ শ্রদ্ধা ও
সম্মানের চোখে দেখতেন; যে নেতার জন্ম না হলে দেশ স্বাধীন হতো না; সব রকমের
ভয়-ভীতি লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে জীবনের-যৌবনের ১৪টি বছর যিনি কারান্তরালে
কাটিয়েছেন; বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে যিনি কোনদিন আপোষ করেন নাই;
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন; বারংবার বক্তৃতায় বলেছেন,
’আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি আমার মানুষের অধিকার চাই’; যিনি সমগ্র
বিশ্বের নির্যাতিত-শোষিত মানুষের মহান নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী—
তাঁকে বিতর্কিত করবার অপচেষ্টা যারা করেছেন বা করছেন তারা আস্তাকুঁড়ে
নিক্ষিপ্ত হয়েছেন বা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের
সদস্যপদ প্রাপ্তির ৪০ বছর পূর্তির এই বছরটিতে পেছন পানে চাইলে দেখি—
শুধুমাত্র স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয়, সেই সাথে
যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন একটি দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শতাধিক দেশের
স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে তথা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ,
ওআইসি এবং মানবজাতির সর্বোচ্চ পার্লামেন্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের
অন্তর্ভুক্তি ও সদস্যপদ অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
লেখক :আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; বাণিজ্য মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার tofailahmed69@gmail.com
No comments:
Post a Comment